প্রতিষ্ঠাতার সংক্ষিপ্ত জীবনী

জনাব আব্দুর রহমান সিকদার

১৯২০-১৯৯৬ ইং

 


জন্মঃ

তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার মাঝিগাতি ইউনিয়নের ডালনিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ সালে জনাব আব্দুর রহমান সিকদার জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সোরবান সিকদার ও মাতার নাম খাতুন

 

 এক ছেলে এক মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। বোনের নাম ছিল আলতা। জনাব আব্দুর রহমান সিকদারের মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা সোরবান সিকদার ইন্তেকাল করেন। সোরবান সিকদারের মৃত্যুর পর গ্রাম ও ইউনিয়নের প্রভাবশালীরা তার যাবতীয় সহায় সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে যায়।

তখন অসহায়, শোকে কাতর, দিকভ্রান্ত বিধবা আব্দুর রহমান সিকদারের মা দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। দুঃখ কষ্টে জর্জরিত মা এতিম দুই শিশুকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে লাগলেন। খেয়ে না খেয়ে ক্ষুধা, অর্ধাহারে, অনাহারে দিনাতিপাত করতেন তাঁরা।

একটা পর্যায়ে শিশু আব্দুর রহমান সিকদারের বয়স যখন ৭ বছর হল, তখন সামান্য কিছু আহারের খোঁজে মায়ের অনুমতি নিয়ে জীবিকার প্রয়োজনে বাধ্যহয়ে তিনি অন্যের জমিতে শ্রম দেওয়া শুরু করলেন। মা বোনের ভরন পোষান যোগাতে বাবাহারা আব্দুর রহমান সিকদারের অবুঝ বয়স থেকেই শুরু হয়ে যায় জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও নির্মম চ্যালেঞ্চ।

 

 

শিক্ষাজীবনঃ

এতিম ও অসহায় হওয়ায় আব্দুর রহমান সিকদার শিশুকালেই মা বোনের অন্য যোগানোর কারণে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাননি। কিন্তু শিক্ষা গ্রহণের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, শিশুকাল থেকেই  বিধবা মা ও তার বোনের আহার জোগাতে তার অন্যের জমিতে শ্রম দেওয়া শুরু করতে হয়।

 

ছোট বেলা থেকেই তিনি মানুষের প্রতি সহমর্মী স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচন্ড পরোপকারী। তার মধ্যে ছিল নের্তত্ব দেওয়ার যাবতীয় গুণাবলী। তিনি অভুক্তকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। খাবারের কষ্ট নিয়ে বেড়া ওঠায় তিনি নিয়মিত ফকির মিসকিনদের খাওয়াতেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন ধর্মভীরু। ছোট বেলা থেকেই তিনি নিয়মিত মসজিদে নামাজ পড়তেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও মাদরাসায় যাতায়াত করতেন। ফলে একটা সময় পূর্ব গোপালগঞ্জের মানুষ তাকে মুসল্লি নামে ডাকতো।  

 

 

বাল্যকালঃ

জনাব আব্দুর রহমান সিকদারের যখন বুঝশক্তি হল, তখন মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁর বাবার লুণ্ঠিত সহায় সম্পত্তি উদ্ধারে চেষ্টা করতে থাকেন। শিশুকালে বাবাকে হারানো এবং লেখা পড়া না জানার কারণে জমি ও অন্যান্য সম্পত্তি উদ্ধার করতে পারেননি।

 

তারপরও তিনি তার প্রচেষ্টায় প্রতিবেশী ও চাচাদের সহযোগীতা নিয়ে সামান্য কিছু সম্পত্তি উদ্ধার করতে সক্ষম হন। যখন বয়স তার ১২ থেকে ১৩। তখন অন্যের জমিতে তিনি বয়স কম হওয়ার কারণে ২ থেকে ৩ দিন শ্রম দিতেন। বিনিময়ে সেই জমির মালিক উদ্ধার করা তাঁর বাবার জমিতে ১দিন শ্রম দিত। এভাবে বছরের পর বছর বাবার জমিতে চাষাবাদ করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন আব্দুর রহমান সিকদারের অসহায় পরিবার। ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে এবং জমি বন্ধক রেখে রেখে নিজের প্রচেষ্টায় কিছু জমিও ক্রয় করে ফেলেন।

 

বৈবাহিক জীবনঃ

জনাব আব্দুর রহমান সিকদার ১৯৪৭ সালে নিজ গ্রামের ....... ফকিরের বড় মেয়ে আলিমোন নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

 

পারিবারিক জীবনঃ

তিনি ৩ পুত্র ও ২ কন্যার জনক ছিলেন। পুত্রদের নাম গোলাম মোস্তফা সিকদার, হেমায়েত উদ্দীন সিকদার ও শাহজাহান সিকদার। কন্যাদের নাম জাহেদা ও শাহেদা।

 

কর্ম জীবনঃ

তিনি তাঁর পৈতৃক ও ক্রয় করা জমিতে চাষাবাদ করে জীবন নির্বাহ করতেন। তৎকালীন সময়ে লেখাপড়া না জেনেও নিজ প্রচেষ্টায় ব্যবসা করতেন। একসময় তাঁর তত্বাবধানে তাঁর বাড়িতে অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।

তিনি গ্রামের লোকজনদের সাথে নিয়ে বড় নৌকায় ধানের ব্যবসা করতেন। বাড়িতে গোয়ালঘর স্থাপন করে বড় বড় গরু লালনপালন করতেন। চাষাবাদ, ব্যবসা ও গরু পালন করে অনেক অসহায়ের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন। সেসময়ে তিনি গ্রামের অন্যতম মহাজন ছিলেন।

 

রাজনৈতিক জীবনঃ

ছোট বেলা থেকেই আব্দুর রহমান সিকদারের মাঝে মানুষকে ভালোবাসার গুনাগুন ছিল। তিনি মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নিতেন। মানুষের দুঃখ দুর্দশায় পাশে দাঁড়াতেন। সাহায্য করতেন। যেহেতু তৎকালীন যুগে সমাজ অধিপতিদের মাধ্যমে সমাজ পরিচালিত হত এবং পঞ্চায়েত কর্তৃক সমাজ নির্দেশিত হত।

ফলে খুব স্বভাবতই আব্দুর রহমান সিকদার তার নেতৃত্বের গুনাবলী দিয়ে তার এলাকার ও আশপাশের মানুষের মন জয় করে ফেলেন। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। বিভিন্ন ধর্মের মানুষও তাঁকে নেতৃত্বের স্থানে মান্য করা শুরু করেন।

 

তিনি তার জন্মস্থান ডালনিয়া এবং মাঝিগাতি, কাঠি, দুর্গাপুর, করপাড়া ইউনিয়নে বিশেষ করে বাঘাজুড়, ডুমরাশুর, কোন্দ্রপগাতী, ধোবলিয়া, কাটরবাড়ী, মালিবাতা, কংশুর প্রভৃতি এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এসব এলাকার মানুষ তাঁকে ভীষণভাবে মান্য করতো। ফলে এসব এলাকার যে কোনো ধরনের বিচার-সালিশ এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি থাকতেন সবার মধ্যমনি।

 

স্কুল প্রতিষ্ঠাঃ

জনাব আব্দুর রহমান সিকদার নিজে নিরক্ষর থেকেও তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী। নিজ গ্রাম ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামের কোমলমতি শিশুদের পড়াশোনার সুবিধার কথা চিন্তা করে তিনি ১৯৬৮ সালে ডালনিয়াবাসীকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল।

স্কুলের প্রতিষ্ঠালগ্নে জমি ক্রয়সহ ফান্ডের প্রয়োজন হওয়ায় দাতাদের উদ্বুদ্ধ করতে তাদের নামে স্কুলের নাম করনের প্রস্তাব করেন। দাতারা উদ্বুদ্ধ হয়ে জমি ক্রয়ে টাকা দান করলে দাতাদের নামানুসারে স্কুলের নাম করণ করা হয় ডালনিয়া আই-এ উচ্চ বিদ্যালয়। পরবর্তীতে সরকারী নির্দেশানুসারে স্কুলের পূর্ণাঙ্গ নাম ডালনিয়া ইসমাইল-আলেফ (আই-এ) উচ্চ বিদ্যালয় রাখা হয়।

জনাব আব্দুর রহমান সিকদার নিজের পাকা ধানের জমি বন্ধক রেখে সেই টাকা স্কুলের ফান্ডে জমা রেখে প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি করান এবং বিভিন্ন সময় সরকারী কাগজপত্র রেডি করে ঢাকায় শিক্ষা অধিদপ্তরে জমা দিতে তৎকালীন সময়ে টাবুরে নৌকায় করে উত্তাল পদ্মানদী পাড়ি দিয়ে দিয়ে ঢাকায় যেতেন।

তিনি স্কুলটিকে দাঁড় করাতে সদলবলে বাড়িতে বাড়িতে যেয়ে ধানসহ বিভিন্ন মৌসুমী ফসল কালেকশন করে তা নিজের বাড়িতে শুকিয়ে-সংরক্ষণ করে স্কুলের ফান্ড তৈরী করতেন।

এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করার অপরাধে বিরোধীদের তোপের মুখে পড়েন জনাব আব্দুর রহমান সিকদার। তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তাঁকে বিরোধীদের তোপের মুখে দীর্ঘকাল পালিয়ে বেড়াতে হয়। তিনি একাধারে দীর্ঘদিন এই স্কুল প্রতিষ্ঠার জেরে মাঝিগাতির সাপ্তাহিক হাটে যেতে পারতেন না। তখন তিনি এলাকাবাসির সম্মতিতে তার প্রতিষ্ঠিত স্কুলের মাঠে সাপ্তাহিক হাটের ব্যবস্থা করেন।

 

এই ক্ষণজন্মা মহান পুরুষ তার পুরোটা জীবনই সামাজিক আন্দোলন ও সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্যে কাটিয়েছেন।


মসজিদ নির্মাণে অন্যন্য ভূমিকা পালনঃ













 

মৃত্যুঃ

এই মহা মনিষী ১৯৯৬ সালের জুন মাসে হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে পড়লে খুলনা সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালেই ১৯৯৬ সালের ১৮ জুনে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তাঁর মুত্যুস্থানে দাফনের শেষ ইচ্ছানুযায়ী খুলনা গোয়ালখালী কেন্দ্রীয় কবরস্থানে মসজিদ সংলগ্ন স্থানে দাফন করা হয়।

আমরা এই কর্মপরায়ন, নিষ্ঠাবান, সৎ, পরোপকারী, ধার্মিক ও শিক্ষানুরাগী  কালের মহামনিষীর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সেই সঙ্গে তার জীবদ্দশায় নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাওয়া সামাজিক কর্মযজ্ঞকে শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করছি।